তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম ও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম ও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম ও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
ইসলামে তাহাজ্জুদ একটি গুরুত্বপূর্ন নামাজ। তাই আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম ও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। যদিও আজকের আর্টিকেলটি বেশ বেশ বড়,তবে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম এবং তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত সম্পর্কে পড়তে পড়তে লম্বা সময় কিভাবে কেটে যাবে তা টের পাবেন না। প্রতিটি লাইন আপনার জানার তৃষ্ণা কে আরো বাড়িয়ে দিবে।
চলুন শুরু করি।
❑ তাহাজ্জুদ নামাজের পরিচয় বা তাহাজ্জুদ নামাজ কি?
‘তাহাজ্জুদ’ শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো: রাত্রিজাগরণ, ঘুম থেকে ওঠা, রাত্রিকালীন ইবাদত ইত্যাদি।
পরিভাষায়, তাহাজ্জুদ মূলত ঐ নামাজকে বলা হয়, যা রাতের বেলায় ঘুম থেকে ওঠে আদায় করা হয়৷ ফায়দ্বুল বারিতে এসেছে, ‘ঘুম থেকে জাগার পর যদি নামাজ পড়ে, তখন তাকে তাহাজ্জুদ নামে নামকরণ করা হয়৷’ [কাশমিরি, ফায়দ্বুল বারি: ২/৪০৭]
ইমাম কুরতুবি (রাহ.)-ও এ কথা বলেছেন। অধিকাংশ আলিমের বক্তব্য এটিই। তাছাড়া দলিলের আলোকে এই মতটিই অগ্রগণ্য। এর বাইরে কোনো কোনো আলেম বলেছেন, মধ্য রাতের পর যে নামাজ পড়া হয়, সেটি তাহাজ্জুদ। আবার কারও মতে, ইশার পরই তাহাজ্জুদ আদায় করা যায়।
তবে, অধিকতর সঠিক মত সেটিই, যা আমরা প্রথমে উল্লেখ করেছি। তা হলো, রাতের বেলা ঘুম থেকে ওঠে নামাজ পড়া।
❑ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের সঠিক সময়
তাহাজ্জুদ নামাজের সর্বোত্তম সময় হলো, শেষ রাত। বিশেষত রাতের অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ পড়া উত্তম।
হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘প্রতি রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের রব পৃথিবীর আসমানে অবতীর্ণ হন এবং বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলেন ডাকার জন্য কি কেউ আছে? যার ডাক আমি শুনবো? চাওয়ার জন্য এমন কেউ কি আছে, যাকে আমি দেব? গুনাহ থেকে মাফ চাওয়ার মত কেউ কি আছে? যার সকল গুনাহ আমি মাফ করব?’’ [মুসলিম, আস-সহিহ ১৮০৮, বুখারি, আস-সহিহ: ১০৯৪;]
❑ তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম
তাহাজ্জুদের নামাজের বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। সাধারণ সুন্নাত বা নফল নামাজের মতই এই নামাজ পড়তে হয়। পাক পবিত্রতা র নিয়ম গুলোও অন্যান্য নামাজের মতই। তবে, চাইলে এটি দুই রাকাত করেও আদায় করা যায়। বিশেষ কোনো সূরা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার কোন বিধান নেই। এটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নফল নামাজ।
– অন্যান্য নামাজের মতই তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত করা।
– অতঃপর ছানা বলা।
– সুরা ফাতিহা পড়া।
– সুরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা বা সূরার অংশবিশেষ বা কেরাত মিলিয়ে পড়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদ নামাজে অনেক লম্বা কেরাত পড়তেন। তারপর, অন্যান্য নামাজের মতই রুকু, সেজদা আদায় করা। এভাবেই প্রথম রাকাতের মতই দ্বিতীয় রাকাআত আদায় করে, তাশাহুদ, দরূদ ও দোয়া মাছুরা পাঠ করে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করতে হবে।
❑ তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাতসংখ্যা বা তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত?
তাহাজ্জুদের নামাজ সর্বনিম্ন ২ রাকাত থেকে শুরু করে ৪, ৬, ৮, ১০ রাকাতও পড়া যায়। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩৫৭ ও ১৩৬২; আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৫১৫৯]
তবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ আমল ছিলো, তিনি অধিকাংশ সময় রাতে ৮ রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। [বুখারি, আস-সহিহ: ১১৪৭]
❑ তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত বা তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলায় নিয়ত
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম জানার মতই তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত জানা খুব জরুরি। এ পর্যায়ে আমরা তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত বাংলা উচ্চারণ সহ শিখব। নিম্নে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত দেওয়া হলঃ-
বাংলা উচ্চারণঃ “নাওয়াইতু আন উছোয়াল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকাতাই ছলাতিত তাহাজ্জুদী সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার।”
অর্থঃ “আমি আল্লাহর ওয়াস্তে কেবলার দিকে মুখ করিয়া তাহাজ্জুদের দু-রাকআত সুন্নাত নামাজের নিয়ত করিলাম। আল্লাহু আকবার।”
❑ তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব, মর্যাদা ও লাভ (আল-কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে)
❖ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীর মর্যাদা অবশ্যই তার চেয়ে বেশি, যে কিনা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যে সকল বান্দা রাতের বেলা সিজদারত থাকে বা (ইবাদতে) দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে, আখিরাতের চিন্তায় শঙ্কিত থাকে এবং নিজ রবের অনুগ্রহ বা দয়া প্রত্যাশা করে, সে বান্দা কি তার সমান, যে এমনটি করে না?’’
❖ তাহাজ্জুদ নামাজ আমাদের নফসের প্ররোচনায় করা গুনাহ গুলোর বাধা দানকারী:
আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই রাত্রিজাগরণ প্রবৃত্তি দমনে অত্যন্ত কার্যকর।’’ [সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত: ৬]
❖ জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম উপায়:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রচলন কোরো, খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তা রক্ষা কোরো এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামাজ আদায় কোরো। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’ [তিরমিযি, আস-সুনান: ২৪৮৫; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৩৩৪; হাদিসটি হাসান সহিহ]
❖ আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভের সুযোগ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা রাতের শেষভাগে বান্দার সবচেয়ে কাছে চলে আসেন। কাজেই যদি পারো, তবে তুমি ওই সময়ে আল্লাহর স্মরণকারীদের মধ্যে শামিল হয়ে যেও। কেননা ওই সময়ের নামাজে ফেরেশতাগণ সূর্যোদয় পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন।’’ [নাসাঈ, আস-সুনান: ৫৭২; তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৫৭৯]
❖ গুনাহের কাফফারা কিংবা শারীরিক রোগমুক্তির উপায় তাহাজ্জুদের নামাজ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমাদের নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া উচিত। এটি তোমাদের পূর্ববর্তী নেককার লোকদের অভ্যাস। এই নামাজ তোমাদেরকে আল্লাহর নিকটে পৌঁছে দেবে, ভুল-ত্রুটিগুলো মিটিয়ে দেবে, গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং শরীর থেকে রোগ দূর করবে।’’ [তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৫৪৯; হাদিসটি সহিহ]
❖ ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ তাহাজ্জুদের নামাজ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো, রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।’’ [মুসলিম, আস-সহিহ: ১১৬৩, তিরমিযি: ৪৩৮]
❖ রাসূলের চিরাচরিত অভ্যাস:
আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘‘কিয়ামুল লাইল (রাতের নামাজ) ত্যাগ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা (কখনো) ত্যাগ করতেন না। যখন তিনি অসুস্থ থাকতেন বা ক্লান্তি অনুভব করতেন, তখন বসে আদায় করতেন। [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩০৯, আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৪৯১৯; হাদিসটি সহিহ]
❑ তাহাজ্জুদ নামাজ কি ইশার নামাজের পর কিংবা ঘুমানোর পূর্বেই পড়া যাবে?
তাহাজ্জুদ নামাজ ও কিয়ামুল লাইল নামাজ কি একই বিষয়? নাকি পার্থক্য আছে?
✪ তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম জানার পূর্বে জানা দরকার তাহাজ্জুদ মানে কি?
তাহাজ্জুদ অর্থ হল ঘুম হতে জাগ্রত হওয়া, রাত্রি কালে জাগরণ করা ইত্যাদি। তাহাজ্জুদ হলো, রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে নফল নামাজ আদায় করা। [কুরতুবি, আল জামি’ লি আহকামিল কুরআন: ১০/৩০৭]
হাজ্জাজ ইবনু আমর আল আনসারি (রা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তাহাজ্জুদ হলো ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে নামাজ আদায় করা। (প্রয়োজনে) আবার ঘুমিয়ে আবার জাগ্রত হয়ে নামাজ আদায় করা। এমনটিই করতেন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।’ [ইবনু হাজার, আত তালখিসুল হাবির: ২/৩৫; হাদিসের সনদ হাসান]
(বিশেষত) ইশার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত শুরুর পূর্ব পর্যন্ত রাতের যে কোনো সময়েই ঘুম থেকে ওঠে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করে নফল পড়া হলে সেটি তাহাজ্জুদ হিসেবে গণ্য হবে। এমনকি কেউ যদি ইশার পর ঘুমিয়ে ১১/১২-টার দিকে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করে নফল পড়ে, তবে সেটিও তাহাজ্জুদের নামাজ হবে। [আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, রাহে বেলায়াত, পৃষ্ঠা: ৫২১]
তবে, ফকিহগণের অনেকেই বলেছেন, রাতের বেলা যেকোনো নফল নামাজই তাহাজ্জুদ বলে গণ্য হবে। এর জন্য ঘুমানো শর্ত নয়, তবে উত্তম। যেমন: হাসান বাসরি (রাহিমাহুল্লাহ্) এমন মত দিয়েছেন। [মাওসু‘আহ ফিকহিয়্যাহ: ২/২৩২; ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম]
সর্বসম্মত মতে, তাহাজ্জুদ এর নামাজের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সময়টি হলো রাত্রের শেষভাগ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘প্রতি রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের আপন রব পৃথীবির আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন—ডাকার জন্য কেউ কি আছে, যার ডাক শুনবো আমি? চাওয়ার জন্য কি এমন কেউ আছে? যাকে আমি দেব? গুনাহ থেকে মাফ চাওয়ার মত কেউ কি আছে? যার সকল গুনাহ আমি মাফ করব?’’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১০৯৪; মুসলিম, আস-সহিহ ১৮০৮]
ইসলাম সম্পর্কে আরো পড়ুন- ইসলামিক শিক্ষা
✪ কিয়ামুল লাইল কি বা কাকে বলে?
কিয়ামুল লাইল শব্দ দুটোর অর্থ রাতের দাঁড়ানো। অর্থাৎ, রাতে ইবাদতের জন্য দাঁড়ানো।
ইশার নামাজের পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত শুরুর পূর্ব পর্যন্ত রাতের বেলা ইবাদতের জন্য দাঁড়ানো বা জেগে থাকাকে কিয়ামুল লাইল বলে। সেই ইবাদত হতে পারে—নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর, দু‘আ, ইলম চর্চা করা ইত্যাদি। এর জন্য ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া জরুরি নয়।
আরেকটু সহজ করে বলা যায়:
◈ কেউ যদি রাতে ঘুম থেকে জেগে নামাজ পড়েন, তবে সেটি তাহাজ্জুদও হবে, কিয়ামুল লাইল (রাত্রিকালীন ইবাদতে দাঁড়ানো)-ও হবে। কিন্তু কেউ যদি রাতে ঘুম থেকে না জেগে নামাজ বা অন্যান্য ইবাদত করেন, তবে সেটি কিয়ামুল লাইল (রাত্রিকালীন ইবাদতে দাঁড়ানো) হবে, কিন্তু তাহাজ্জুদ হবে না। কারণ তাহাজ্জুদের জন্য ঘুম থেকে জাগা শর্ত। যদিও কোনো কোনো আলিম ঘুম থেকে জাগা শর্তারোপ করেননি। তবে, আমরা হাদিসে দেখেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিগণের আমল ছিলো ঘুম থেকে জেগে নামাজ পড়া। তাই, এটিই প্রধান্যপ্রাপ্ত মত। তাই, উত্তম হবে—ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদরূপে কিয়ামুল লাইল আদায় করা।
◈ তাহাজ্জুদ কেবল নামাজ পড়াকেই বলে; পক্ষান্তরে কিয়ামুল লাইল দ্বারা শুধু নামাজই নয়, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর, দু‘আ, ইলম চর্চা করা ইত্যাদিও বোঝায়।
❑ ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদ পড়তে না পারলেও হতাশার কিছু নেই। ইশার পর রাতের যেকোনো সময়ে কিয়ামুল লাইল পড়াও অনেক বড় ইবাদত। অনেক হাদিস আছে এ ব্যাপারে। তবে হ্যাঁ, ঘুম থেকে জেগে ইবাদতের সমতূল্য নয়।
যারা তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন না, তারা অন্তত কিয়ামুল লাইল আদায় করুন। কিয়ামুল লাইল তুলনামূলক সহজ। তাহাজ্জুদের সমান না হলেও এর অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে।
❑ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নিকট তাহাজ্জুদ আদায়ের বিশেষ গুরুত্ব, প্রশংসা ও ফজিলতসমূহ
◈ রাত জেগে ইবাদতকারীদের ব্যাপারে মহান আল্লাহর প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা:
◉ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যে সকল বান্দা রাতের বেলা সিজদারত থাকে বা (ইবাদতে) দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে, আখিরাতের চিন্তায় শঙ্কিত থাকে এবং নিজ রবের অনুগ্রহ বা দয়া প্রত্যাশা করে, সে বান্দা কি তার সমান, যে এমনটি করে না?’’ [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৯]
◉ আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা বলেন, ‘‘তারা রাতের সামান্য অংশই ঘুমিয়ে কাটাতো। আর রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকতো।” [সূরা যারিয়াত, আয়াত: ১৭-১৮]
◉ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, “তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা থাকে। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি, তা থেকে তারা ব্যায় করে। অতঃপর, কোনো ব্যক্তি জানে না, তাদের জন্য চোখ জুড়ানো কী জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে—তারা যা করতো, তার বিনিময়স্বরূপ।” [সূরা সাজদাহ, আয়াত: ১৬-১৭]
◉ আল্লাহ্ আযযা ওয়া জাল্লা বলেন, ‘‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে, মূর্খ ব্যক্তিরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে কথা বলে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’ এবং তারা রাত্রিযাপন করে তাদের রবের উদ্দেশ্যে—সিজদাবনত ও দণ্ডায়মান হয়ে।’’ [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৩-৬৪]
◉ মহান আল্লাহ্ বলেন, “আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় কোরো— তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।” [সূরা ইসরা, আয়াত: ৭৯]
◉ আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন, “তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তারা সিজদা করে।” [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১১৩]
◈ তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম ও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত এর ব্যাপারে নবিজির সিরিয়াসনেস:
হযরত আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) হইতে বর্ণিত যে; তিনি বলেন, ‘নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাত্রি বেলায় (নামাজে মধ্যে) এরকমভাবে কিয়াম করতেন যে, উনার পা ফুলে ফাটার উপক্রম হয়ে যেতো!’ একবার আমি তাঁকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার তো পূর্ব ও পরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, কোন গুনাহ লিপিবদ্ধ হবে না, তবুও কেন নামাজে এভাবে কষ্ট করছেন?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘‘আমি (আল্লাহর) কৃতজ্ঞ বান্দা কি হবো না?’’ [মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৩১, বুখারি, আস-সহিহ: ৪৮৩৭;]
আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, ‘কিয়ামুল লাইল (রাতের নামাজ) ত্যাগ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (কখনো) এটি ত্যাগ করতেন না। যখন তিনি অসুস্থ থাকতেন বা ক্লান্তি অনুভব করতেন, তখন বসে আদায় করতেন।’ [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩০৯, আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৪৯১৯; হাদিসটি সহিহ]
◈ নিকটাত্মীয়দের তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও তাহাজ্জুদ পড়ার ব্যাপারে নবিজি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
আলি (রা.) হতে বর্ণিত; একবার নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ও ফাতিমার নিকট রাতের বেলায় আগমন করলেন এবং (তাঁদেরকে বিছানায় দেখে) বললেন, ‘‘তোমরা (স্বামী-স্ত্রী) কি (তাহাজ্জুদের) নামাজ পড়ো না?’’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১১২৭; মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৭৫]
◈ তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম ও তাহাজ্জুদ পড়ার ব্যাপারে সাহাবিদেরকে তিনি উদ্বুদ্ধ করতেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা.)-কে বললেন, ‘‘আবদুল্লাহ (ইবনু উমার) কতই-না ভালো মানুষ! যদি সে রাতে ওঠে নামাজ পড়তো (তবে তো আরও ভালো হতো)!’’ আবদুল্লাহ্ ইবনু উমারের ছেলে সালিম বলেন, ‘তারপর থেকে (আমার আব্বা) আব্দুল্লাহ রাতে অল্পই ঘুমাতেন।’ [বুখারি, আস-সহিহ: ৪৪০; মুসলিম, আস-সহিহ: ২৪৭৮]
❑তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম ও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত , তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাদিসঃ
◈ তাহাজ্জুদ রেগুলার পড়া উত্তম; তবে, বাধ্যতামূলক নয়। যারা বলে, তাহাজ্জুদ পড়লে প্রতিনিয়ত পড়তে হয়, তাদের কথা সঠিক নয়।
বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা.) হইতে বর্ণিত; তিনি বলেন যে, ‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন, ‘‘আব্দুল্লাহ! তুমি তার মতোই হয়ে যেও না, যে রাতে জেগে ইবাদত করতো, কিন্তু তারপর তা ছেড়ে দিলো।’’ ’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১১৩১; মুসলিম: ১১৫৯]
রাসূলের এই আদেশ বাধ্যতামূলক নয়; রাতের ইবাদতের জন্য উৎসাহমূলক।
◈ দাউদি নামাজ আল্লাহর কাছে প্রিয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট প্রিয়তম নামাজ হলো দাউদ (আ.)-এর নামাজ। তিনি অর্ধরাত পর্যন্ত ঘুমোতেন। এরপর রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত নামাজে কাটাতেন। অতঃপর, আবার রাতের এক ষষ্ঠাংশ ঘুমোতেন।’’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১০৭৯]
◈ স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে জাগিয়ে রাতের বেলায় ইবাদতের বিরাট ফজিলত:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি দয়া করুন, যে রাতে উঠে ইবাদত করে এবং নিজ স্ত্রীকেও জাগায়। অতঃপর যদি সে (জাগতে) অস্বীকার করে, তাহলে তার মুখে পানির ছিটা দেয়। একইভাবে, আল্লাহ সেই নারীর প্রতি দয়া করুন, যে রাতে উঠে ইবাদত করে এবং নিজ স্বামীকেও জাগায়। অতঃপর যদি সে (জাগতে) অস্বীকার করে, তাহলে সে তার মুখে পানির ছিটা দেয়।” [নাসায়ি, আস-সুনান: ১৬১০; আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩০৮; হাদিসটির সনদ সহিহ]
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘‘তাদের (নাম) যিকিরকারী ও যিকিরকারিনীর মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়।” [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩০৯, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান:১৩৩৫; হাদিসটির সনদ সহিহ]
◈ রাতে দু‘আ কবুলের বিশেষ সময়টি শেষ রাতে হওয়ার সম্ভবানা বেশি:
হযরত জাবির (রা.) হইতে বর্ণিত; তিনি বললেন, ‘আমি নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন কথা বলতে শুনেছি যে, “রাত্রের বেলা এমন একটি সময় রয়েছে, যখন কোনো মুসলিম ব্যক্তি তখন দুনিয়া ও আখিরাত বিষয়ক যে কোনো উত্তম জিনিস প্রার্থনা করলে, মহান আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তাকে তা দিয়ে থাকেন। সেই সময়টি প্রত্যেক রাতেই থাকে।” [মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৫৭]
◈ যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে স্বাচ্ছন্দের সাথে তাহাজ্জুদ পড়তে পারবে, ততক্ষণ তাহাজ্জুদ পড়বে; যখন চোখে ঘুম পাবে শুয়ে পড়বে।
আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত; নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ নামাজের মধ্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, তখন সে যেন ঘুমিয়ে পড়ে—যতক্ষণ না তার ঘুমের চাপ দূর হয়। কারণ, যখন কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে নামাজ পড়বে, তখন সে হয়ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়ে নিজেকে গালি দিয়ে বসবে।” [বুখারি, আস-সহিহ: ২১২; মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৮৬]
◈ রেগুলার তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম জেনে তাহাজ্জুদ আদায়কারী কখনো তাহাজ্জুদ মিস করে ফেললে করণীয়:
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি স্বীয় হিযব (দৈনিক একটি রুটিন অনুসারে রাত জেগে ইবাদত) সম্পন্ন করে না অথবা তার অল্প কিছু অংশ না পড়ে ঘুমিয়ে যায়, অতঃপর যদি সে ফজর এবং যোহরের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে তা আদায় করে নেয়, তাহলে তার জন্য এমনভাবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়, যেন সে তা রাত্রেই পড়েছে।” [মালিক, আল-মুওয়াত্তা: ৪৭০ মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৪৭;]
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম জেনে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের ব্যাপারে পূর্বসূরি নেককার ব্যক্তিদের বেশ চমৎকার কিছু অভিজ্ঞতা ও মন্তব্য:
◈ তাহাজ্জুদ নামাজে চেহারা সুন্দর হয়।
ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন, ‘কিছু সংখ্যক নারী অধিক পরিমাণে রাতের নামাজ আদায় করতো। তাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলে, ‘‘রাতের নামাজ চেহারা সৌন্দর্যময় করে; আমি আমার চেহারাকে লাবণ্যময় করতে পছন্দ করি।’’ ’ [ইবনুল কায়্যিম, রাওদ্বতুল মুহিব্বিন: ২২১]
তবে, কেউ যদি কেবল চেহারা সুন্দর হওয়ার জন্য তাহাজ্জুদ আদায় করেন, তার কোনো নেকি তো হবেই না, চেহারা সুন্দর হওয়ারও সম্ভাবনা থাকবে না। উপরে যে নারীদের কথা বলা হয়েছে, তারা মূলত ইবাদতের নিয়তেই তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। চেহারা সুন্দর হওয়ার বিষয়টি ছিলো বোনাস হিসেবে।
ইমাম হাসান আল বাসরি (রাহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীরা কেনো জ্যোতির্ময় চেহারার অধিকারী হয়?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘তাঁরা আল্লাহর সাথে নিভৃতে অবস্থান করেন, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিশেষ জ্যোতির্ময় পোষাক পরিধান করান।’ [ইবনুল জাওযি, আল-মাওয়া‘ইয: ১২১]
◈ মানুষের ভালোবাসা অর্জিত হয়।
তাবিয়ি সায়িদ ইবনুল মুসায়্যিব (রাহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে নামাজ আদায় করে, আল্লাহ্ তার চেহারায় নূর (জ্যোতি) উদ্ভাসিত করে দেন। প্রত্যেক মুসলিম তাকে ভালোবাসে; যদিও পূর্বে কখনও তাকে না দেখে থাকে। তারা বলে, ‘‘এই লোকটিকে আমার ভালো লাগে।’’ ’ [আবদুল হক, কিতাবুত তাহাজ্জুদ]
◈ আনন্দের সাথে দিন শুরু হয় তাদের।
ইমাম আত্বা আল খুরাসানি (রাহ.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন রাতে ইবাদত করে, পরের দিন সে এমন আনন্দ নিয়ে জাগ্রত হয়, যা সে অন্তর থেকে অনুভব করতে পারে।’ [ইবনু আবিদ দুনিয়া, আত তাহাজ্জুদ ওয়া কিয়ামুল লাইল: ১৭]
এই ব্যাপারে সহিহ হাদিসও আছে। সে প্রফুল্লহৃদয়ে দিন শুরু করে।
◈ গুনাহের কারণে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়।
ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন, ‘আমি একটি মাত্র গুনাহের কারণে পাঁচ মাস কিয়ামুল লাইল থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘সেটি কী গোনাহ ছিলো?’ তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি কাঁদছিলো, আমি তাকে ‘লোকদেখানো কান্নাকারী’ বলেছিলাম।’ [আবু নু‘আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া: ৭/১৮]
ফুদ্বাইল ইবনু ইয়াদ্ব (রাহ.) বলেন, ‘যখন তুমি রাত্রিজাগরণে সক্ষম হবে না, দিনেও সিয়াম পালন করতে পারবে না, তখন বুঝে নেবে, তুমি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত। তোমার পাপ তোমার হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে।’ [ইবনুল জাওযি, সিফাতুস সাফওয়া: ২/২৩৮]
◈ বিশেষত হারাম ইনকাম এবং কুদৃষ্টির ফলে তাহাজ্জুদ নসিব হয় না অনেকের।
আবু সুলায়মান আদ-দারানি (রাহ.) বলেন, ‘এমন কত (হারাম) লোকমা আছে, যা কিয়ামুল লাইলে বাধা দিয়েছে! এমন কত (হারাম) দৃষ্টি আছে, যা সূরা তিলাওয়াত থেকে বঞ্চিত করেছে।’ [আবু নু‘আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া: ২/৩০৭]
◈ একজন সালাফ একদিন কোনো কারণবশত কিয়ামুল লাইল মিস করে ফেলেন। এই শোকে তিনি কান্না শুরু করে দেন। কোনো কোনো সালাফ বলতেন, রাতের নামাজ না থাকলে তাদের জীবনে আনন্দ বলতে কিছু থাকতো না।
শাদ্দাদ বিন আউস (রাহ.) রাতে বিছানায় গেলে জলন্ত কড়াইয়ের শস্যদানার ন্যায় ছটফট করতেন আর বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তোমার জাহান্নামের ভয় আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।’ এরপর সকাল পর্যন্ত নামাজ আদায় করতেন। [ইবনুল জাওযি, সিফাতুস সাফওয়া: ১/৭০৯]
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত ও তাহাজ্জুদ নামাজকে সুন্দর ও যথার্থ করতে কিছু সুন্নাহ্ ও আদব মেনে চলা উচিত।
◈ ঘুম থেকে জাগার পর নির্দিষ্ট দু‘আ পড়া।
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে এই দু‘আ পাঠ করবে—
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَسُبْحَانَ اللّٰهِ وَلَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللّٰهِ
[লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া‘হদাহু লা শারী-কা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল ‘হামদু, ওয়া হুওয়া ‘আলা কুল্লি শাই-ইন ক্বাদী-র, আল‘হামদুলিল্লাহ, ওয়া সুব‘হানাল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা ‘হাওলা ওয়া লা ক্বুও-ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ]
(অর্থ: আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি এক; তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা ও তাঁর জন্যই রাজত্ব; তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা। আল্লাহ পুতঃপবিত্র। আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো অবলম্বন নেই; কোনো সামর্থ্য নেই)
অথবা সে বলে, ‘আল্লাহুম্মাগফিরলি’
(হে আল্লাহ, আপনি আমাকে মাফ করে দিন) কিংবা সে যেকোনো দু‘আ করে, তাহলে তার দু‘আ কবুল করা হয়। আর, যদি সে অজু করে এবং নামাজ আদায় করে, তাহলে তার নামাজ কবুল করা হয়। [বুখারি, আস-সহিহ: ১১৫৪]
◈ ঘুম থেকে জেগে সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পাঠ করা উত্তম।
একটি হাদিসে এসেছে, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে ঘুম থেকে জেগে ঘুমের ঘোর কাটানোর পর সূরা আ-লে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পাঠ করেন। এরপর অজু করেন এবং নামাজ পড়েন। [বুখারি, আস-সহিহ: ১৮৩; মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৮৩]
এই হাদিসের আলোকে ইমাম নববি (রাহ.) বলেন, ঘুম থেকে জেগে সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পড়া উত্তম। (বিশেষত কিয়ামুল লাইলের জন্য জাগলে)।
◈ তাহাজ্জুদের জন্য উঠে অজুর পূর্বে মিসওয়াক করা মুস্তাহাব।
হুযাইফা (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলা যখন তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠতেন, তখন মিস্ওয়াক দ্বারা তাঁর মুখ পরিষ্কার করে নিতেন।’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১০৭০]
◈ তাহাজ্জুদের নামাজ প্রথমে স্বল্প-পরিসরে দুই রাকাত দিয়ে শুরু করা উত্তম।
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ রাতে নামাজ পড়ার জন্য উঠবে, সে যেন হাল্কাভাবে দুই রাকাত পড়ার মাধ্যমে নামাজ শুরু করে।” [মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৬৮, আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩২৩]
◈ তাহাজ্জুদে দীর্ঘ কিয়াম করে অধিক পরিমাণে কুরআন পড়া উত্তম:
জাবির (রা.) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কোন নামাজ সর্বোত্তম?’ তিনি বলেন, ‘‘যে নামাজে দীর্ঘ কিয়াম (দাঁড়িয়ে থাকা) হয়।’’ [মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৫৬]
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘রাতে আমি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নামাজ আদায় করলাম। তিনি এত দীর্ঘ সময় (নামাজে) দাঁড়িয়ে থাকলেন যে, আমি একটি মন্দ কাজের ইচ্ছা করে ফেলেছিলাম।’ (আবু ওয়াইল বলেন) আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কী ইচ্ছা করেছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘ইচ্ছা করেছিলাম, বসে পড়ি এবং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইকতিদা ছেড়ে দিই।’ [বুখারি, আস-সহিহ: ১০৬৯]
যাদের বড় সূরা মুখস্থ নেই, তারা অনেকগুলো ছোট সূরা প্রতি রাকাতে পড়তে পারেন। তাহলে কিয়াম দীর্ঘ হবে।
◈ তাহাজ্জুদের নামাজ ২ রাকাত করে আদায় করা উত্তম; তবে, একত্রে চার রাকাত পড়াও বৈধ।
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘রাতের নামাজ দুই দুই রাকাত করে।’’ [বুখারি, আস-সহিহ: ৪৭২; মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৪৯]
◈ তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাতসংখ্যা:
তাহাজ্জুদের নামাজ সর্বনিম্ন ২ রাকাত থেকে শুরু করে ৪, ৬, ৮, ১০ রাকাতও পড়া যায়। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩৫৭ ও ১৩৬২; আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৫১৫৯]
তবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ আমল ছিলো, তিনি অধিকাংশ সময় রাতে ৮ রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। [বুখারি, আস-সহিহ: ১১৪৭]
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম ও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করার জন্য ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার কিছু উপায় ও কৌশল এবং তাহাজ্জুদ আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতার সমাধান
✿ তাহাজ্জুদের জন্য ওঠার উপায় ও কৌশল:
মূলত আল্লাহ্ যাকে চান, তাকেই তাহাজ্জুদের জন্য কবুল করেন। আল্লাহর বাছাইকৃত লিস্টে ওঠতে পারলেই তাহাজ্জুদ আদায় সহজ হয়ে যায়। কতিপয় কৌশল ও উপায় অবলম্বন করে আমরা তাহাজ্জুদের জন্য ওঠতে পারি, ইনশাআল্লাহ্।
১) গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
ফুদ্বাইল ইবনু ইয়াদ্ব (রাহ.) বলেন, ‘যখন তুমি রাত্রিজাগরণে সক্ষম হবে না, দিনেও সিয়াম পালন করতে পারবে না, তখন বুঝে নেবে, তুমি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত। তোমার পাপ তোমার হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে।’ [ইবনুল জাওযি, সিফাতুস সাফওয়া: ২/২৩৮]
২) আগে আগে ঘুমিয়ে পড়া। সর্বোচ্চ, রাত ১০-টা বা ১১-টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া উচিত। উত্তম হলো ইশার পরপর ঘুমানো।
আবু বারযা আসলামি (রা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার আগে ঘুমানো এবং ইশার পর কথা-বার্তা বলা অপছন্দ করতেন।’ [বুখারি, আস-সহিহ: ৫৭৪]
৩) তাহাজ্জুদের নিয়ত করে ঘুমানো।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি রাতে (তাহাজ্জুদের) নামাজ আদায়ের ইচ্ছা করা সত্ত্বেও ঘুম তাকে পরাজিত করে দিলো, তার আমলনামায় রাতে নামাজ আদায়ের সওয়াবই লিখা হবে। তার জন্য ঘুম (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সাদাকাহ হিসেবে গণ্য হবে।’’ [আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৩১৪; নাসায়ি, আস-সুনান: ১৭৮৩; হাদিসটি সহিহ]
৪) রাতে কম খাওয়া ও কম পান করা। অধিক খেলে বা পান করলে শরীর অলস হয়ে যায়। তখন চাইলেও আরামের বিছানা ছাড়তে মন চায় না।
৫) তাহাজ্জুদের ফজিলত, গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা। তাহলে এর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে।
৬) তাহাজ্জুদে ওঠার জন্য নিজের নিয়তকে একনিষ্ঠ করা ও সাধনা করা। তাহলে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবে।
৭) আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে দু‘আ করা। কারণ তাহাজ্জুদকে হাদিসে বলা হয়েছে ‘মুমিনের সম্মান’। আল্লাহর কাছে এই সম্মানের অধিকারী হওয়ার তাওফিক চাইতে হবে।
৮) প্রযুক্তির উত্তম ব্যবহার করা। বিশেষত আমরা মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে পারি। তবে, অবশ্যই মোবাইলটা সিথানের পাশে থাকবে না। একটু দূরে রাখবেন। না হয় ঘুমের ঘোরে অ্যালার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে যাবেন। তাছাড়া, মোবাইল থেকে ক্ষতিকর রশ্মি বের হয়, যা স্বাস্থের জন্যও ক্ষতিকর। তাই, মেডিকেল সাইন্স মোবাইল দূরে রেখে ঘুমোতে বলে।
৯) ঘুমানোর সুন্নাত ও আদবগুলো পালন করা। বিশেষত মাসনুন যিকরগুলো পড়া এবং অজু করে যিকর করতে করতে ডান কাতে শুয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া।
✿ তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ভালো না লাগা:
অনেকেই তাহাজ্জুদ পড়েন ঠিকই, কিন্তু মানসিকভাবে খুব একটা প্রশান্তি অনুভব করেন না। তারা একটা পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়েন। মূলত, এটি তাদের ভুল পদ্ধতি। প্রথম দিকে অনেকের তাহাজ্জুদ আদায়ে কষ্ট হলেও পরে এর স্বাদ অনুভূত হতে থাকে। আমাদের পূর্বসূরি নেককার ব্যক্তিরাও এমনটি বলে গেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে।
তাবি‘ঈদের নেতা সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (রাহ.) বলেন, ‘বিশ বছর যাবত আমি কষ্ট করে তাহাজ্জুদ আদায় করেছি। আর বিশ বছর ধরে তাহাজ্জুদের স্বাদ উপভোগ করেছি।’ [আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা: ২১৪]
একই উক্তি তাবি‘ঈ সাবিত বুনানি (রাহ.) থেকেও বর্ণিত আছে। [আবু নু‘আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া: ২/৩২০]
✿ তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে গিয়ে জিনের ভয়:
এটি সম্পূর্ণ মানসিক সমস্যা এবং শয়তানের ধোঁকা। তাহাজ্জুদ পড়তে গিয়ে কেউ জিনের আক্রমণের মুখোমুখি হয় না।
সহিহ হাদিসে এসেছে, ‘‘এই সময়ের (তাহাজ্জুদের) নামাজে ফেরেশতাগণ সূর্যোদয় পর্যন্ত উপস্থিত থাকেন।’’ [তিরমিযি, আস-সুনান: ৩৫৭৯; নাসাঈ, আস-সুনান: ৫৭২]
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম সম্পর্কে আরো জানুন বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার মিজানুর রহমান আজহারি হুজুরের ভিডীওতে
2 Comments