নামাজে মনোযোগী হওয়ার উপায়
নামাজে মনোযোগী হওয়ার উপায়
নামাজে মনোযোগী হওয়ার উপায় গুলো কি কি?
আমার উস্তাদাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “উস্তাদা! কীভাবে নামাজের মধ্যে আল্লাহকে মনে রাখবো? শয়তান যে বার বার আমাকে ভুলিয়ে দেয়!” তখন উস্তাদা খুব দামী একটা কথা বললেন যে, “আমরা নামাজের ভিতর আল্লাহকে মনে রাখতে হলে আগে অবশ্যই নামাজের বাইরে আল্লাহকে মনে রাখার অভ্যাস করতে হবে!” সুবহানআল্লাহ! নামাজের বাহিরে যদি আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা হয়, তাহলে নামাজের ভিতরেও আল্লাহর স্মরণ আসবে—এই সহজ সূত্রটা আমরা বুঝি না। আজকের টপিকে আমরা নামাজে মনোযোগী হওয়ার উপায় সম্পর্কে এমন কিছু অনুশীলনের কথা জানব যা আমল করলে প্রকৃতপক্ষে আমাদের নামাজ আরও সুন্দর হবে ইনশাআল্লহ।
- নামাজে মনোযোগী হওয়ার উপায় গুলো মধ্যে প্রথমে আমাদের যে আমল টি করা উচিত তা হল। নামাজ শুরু সময় হবার দশ-পনেরো মিনিট আগে থেকেই নিজ নিজ কাজ থেকে উঠে নামাজের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করা। কারণ, দেখা যায়, তুমুল চিন্তার ঝড় নিয়ে দুনিয়াবী একটা কাজ করছি। আযান শুনে কোনমতে সেই কাজ থেকে উঠে ফট করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। অথচ তখনো মাথায় ঐ দুনিয়াবী কাজের কথাই ঘুরছে! নামাজ শুরুর ১০ মিনিট আগে সোশাল মিডিয়া থেকে লগ-আউট করুন, লিখার কলমটা নামিয়ে ফেলুন, বই বন্ধ করে ফেলুন, মাজলিশ থেকে উঠে পড়ুন। চলে যান ওযু করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের প্রস্তুতি নিতে। নামাজের মধ্যে আল্লাহর সাথে কানেক্টেড হবার জন্যে নামাজের বাইরের অন্য সব কিছুর সাথে ডিসকানেক্টেড হওয়া জরুরি।
- নামাজের জন্যে প্রস্তুত হবার সময় আমাদের উচিত সুন্দর একটা কাপড় পরা। আমরা বাসার মশলা-ময়লা মাখানো কাপড়টা পরেই নামাজে দাঁড়িয়ে যাই। নামাজে মনোযোগ না থাকার এটাও একটা কারণ। যে কোন অফিসের মিটিং এ আমরা কত সুন্দর পরিপাটি হয়ে যাই। অথচ এটা হচ্ছে আমাদের আল্লাহর সাথে মিটিং – দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং! পরিপাটি হয়ে মহান আল্লাহর সামনে দাঁড় হবার প্রস্তুতি নেওয়াও অন্তরের একটি রুহানী প্রভাব তৈরি করে। এটি নামাজে মনোযোগী হওয়ার উপায় গুলোর মধ্য অন্যতম।আমার উস্তাদ কিছু সুন্দর সুন্দর নতুন লং ড্রেস আলাদা করে রাখতেন শুধুমাত্র নামাজের সময় পরার জন্যে। এই জামাগুলো ছিল সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির, দামী এবং দেখতেও বেশ! এগুলো তিনি অন্য কোথাও পরতেন না। কেবল আল্লাহর সাথে মিটিং এর সময় পরতেন! এতে মানসিকভাবে তিনি প্রস্তুত হতেন যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারো সামনে দাঁড়ানোর জন্যে রেডি হচ্ছেন! এতে নামাজের মনোযোগ বেড়ে যেত।
- ওযু করা এবং সুন্দর নামাজের কাপড় পরিধান করার পর্ব শেষ। এবার মন কে নামাজে ফেরাতে জায়নামাজে বসে একটু যিক্র বা ধ্যান করা যেতে পারে। সিম্পলী বলুন, “আল্লাহ! আমি আপনার সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি! আমাকে নামাজের মিষ্টি স্বাদ অনুভব করার তাওফিক দিন”। অর্থাৎ, নামাজে মনোযোগী হওয়ার একটি উপায় হল নামাজে দাড়াবার পূর্বে এমন ভাবা যে আমি আল্লাহর সামনে দাড়াচ্ছি।
- যেই সূরাগুলি নামাজে পড়া হবে এই সময়ে সেগুলো ঠিক করে নেওয়া যায়। ফোনের কুরআন App খুলে চট করে ছোট সূরাগুলোর অর্থ পড়ে নেওয়া যায়। ফোনে অর্থ পড়তে গিয়ে অন্য এপে গিয়ে অমনোযোগী হবার সম্ভাবনা থাকলে বাসার কুরআনের হার্ডকপি থেকে সূরা গুলোর অর্থ দেখে নেওয়া যায়। তাহলে সূরা পাঠের সময় নামাজে মনোযোগ থাকবে এবং কোন সূরার পর কোনটা পড়বো এটা নিয়ে নামাজের মাঝে চিন্তা করতে হবেনা।
- আমরা সাধারণত যেসব সূরাহ, তাসবীহ, দুয়া ইত্যাদি নামাজের মধ্যে পড়ে থাকি, সেগুলোর অর্থ জেনে নেওয়া। সেজন্যে “নামাজে মন ফেরানো” এই সিরিজটা পুরোটাই আপনারা নিয়মিত রিভিউ করবেন। এই সিরিজটি এমন একটি লিখা যেটার কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসতে হবে। একবার শেয়ার করে টাইমলাইনে রেখে দিয়ে আবার ভুলে গেলে কিন্তু কাজ হবে না। যতবার আপনার মনে হবে শায়তান নামাজ থেকে মনকে সরিয়ে দিচ্ছে, ততবার এই সিরিজের লিখাগুলোর কাছে ফিরে আসুন। এই সিরিজের পর্বগুলো বার বার পড়ুন, পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলুন, আপনার প্রিয় জনদেরকেও শিখিয়ে দিন। তারাও যেন নামাজে মধুর স্বাদ পায়। অথবা যদি আপনাদের কাছে এর চেয়েও ভালো কোন রিসোর্স থাকে, তবে সেখান থেকে পড়ুন।
- জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নিয়ত পড়ে হাত বাঁধার পূর্বে চিন্তা করুন, “এটাই যদি আপনার জীবনের শেষ নামাজ হয়, তাহলে আপনি নামাজটা কীভাবে পড়বেন?” দেখবেন নামাজের কোয়ালিটি বেড়ে যাচ্ছে।
- নামাজের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় হাত-পা নাড়ানো উচিত না। যত কম অহেতুক নাড়াচাড়া করবেন, তত বেশি নামাজে মনোযোগ বাড়বে। মাঝে মাঝে বোনেদেরকে দেখি, নামাজের মধ্যে বার বার মাথার ঘোমটা বা হিজাব ঠিক করছেন।আমাদের বোনেদের উচিত হিজাবটা সুন্দর করে টাইট করে বেঁধে তবেই নামাজে দাঁড়ানো। যেন নামাজের মধ্যে বার বার হিজাব ঠিক করতে না হয়। এমন কাপড়ের হিজাব আমরা পরবো না যেটা পিচ্ছিল বা সিল্ক জাতীয় এবং এর ফলে বার বার মাথা থেকে পড়ে যেতে চাইবে এবং নামাজের মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটাবে।
- নামাজের মধ্যে চোখের দৃষ্টি সিজদার জায়গার দিকে স্থির রাখা উচিত। আড়চোখ করে এদিকে সেদিকে তাকানো থেকে বিরত থাকা নামাজের কোয়ালিটিকে বাড়িয়ে দিবে।
- নামাজের শেষ করে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে একটু যিকির করা। নামাজ শেষে পড়ার জন্যে দুয়া-যিকির নিয়ে আমরা পর্ব ১০ এবং ১১ তে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
- নামাজ শেষ করার পর নিজেকে জিজ্ঞেস করা যে, যেই নামাজটা আমি এই মাত্র পড়লাম তা কি আল্লাহর দরবারে পেশ করার মতন যোগ্য? আমার আদায় করা এই নামাজ কি কবরে আমার নিজের জন্যে আলো হয়ে আসার যোগ্য? নাকি কেয়ামতের দিনের হিসেবে যারা নামাজের হক সঠিক ভাবে আদায় করতে পারেনি তাদের নামাজের মতই আমার নামাজকেও পোঁটলায় ভরে আমার মুখে ছুঁড়ে ফেলা হবে? আমি কিভাবে পরের বার আমার নামাজকে আরো সুন্দর করতে কী কী করতে পারি?
নামাজে মনোযোগী হওয়ার উপায় নিয়ে হাদিস সমূহঃ
★ সর্ব প্রথম বান্দার সালাতের হিসাব নেয়া হবে। তাতে হয় সে মুক্তি পাবে অথবা ধ্বংস হবে। রসূল (ﷺ) বলেন: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার সালাতের হিসাব হবে। যদি সালাত ঠিক হয় তবে তার সকল আমল সঠিক বিবেচিত হবে। আর যদি সালাত বিনষ্ট হয় তবে তার সকল আমলই বিনষ্ট বিবেচিত হবে। [তিরমিযি:২৭৮]
★ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) (ﷺ)কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, আল্লাহর কাছে কোন আমল সবচেয়ে বেশি প্রিয় ? আল্লাহর রাসূল বলেন-সময় মত সালাত আদায় করা। আবারো জিজ্ঞাসা করা হল, তার পর কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন-মাতা পিতার সাথে সর্বদা সদাচরন করা। আবার জিজ্ঞাসা করা হল তার পর কোনটি? উত্তরে বললেন আল্লাহর পথে জিহাদ করা।” [বুখারী:৪৯৬]
আরো পড়ুন- ওযু কাকে বলে? ওযুর ফরজ কয়টি ও কি কি?
আরো পড়ুন-তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম ও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
★ “তুমি বেশি করে মহান আল্লাহর জন্য সিজদা-সালাত আদায় করতে থাক, কেননা তোমার প্রতিটি সিজদার কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তোমার গুনাহ গুলো মাপ করবেন।” [মুসলিম:৭৩৫]
★“তোমরা ধৈর্য এবং সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। যদিও তা কঠিন কিন্তু বিনীতগণের জন্যে নয়। যারা ধারণা করেন যে নিশ্চয় তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে এবং তারা তারই দিকে প্রতিগমন করবে।” [সুরা বাকারাহ : ৪৫,৪৬]
★ “সেসব মুমিনগণ সফলকাম, যারা তাদের সালাতে নম্রতা এবং ভীতির সাথে দণ্ডায়মান হয়।” [সূরা মুমিনঃ ১-২]।
অতঃপর বলেন যে: “আর যারা তাদের সালাত আদায়ে যত্নবান, তারাই জান্নাতের ওয়ারিশ- যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের ওয়ারিশ হবে এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে।” [সুরা আল-মোমিন: ৯,১০,১১]
ইয়া রাব্বুল আলামিন! আমাদেরকে এমন ভাবে সালাত আদায়ের তাওফিক দিন যেটা আমাদের দ্বীন, দুনিয়া এবং আখিরাতের জন্যে কল্যাণের উৎস হয় এবং আপনার সন্তুষ্টি ও জান্নাত অর্জনের উসিলাহ হয়! আমিন।
প্রতিটা কথা আমার নিজের জন্যে সবার আগে রিমাইন্ডার। আমার এই সম্পূর্ণ সিরিজে যা কিছু ভালো পুরোটাই আল্লাহর তরফ থেকে এবং এখানের ভুলত্রুটিগুলো আমার এবং শায়তানের তরফ থেকে। আপনারা উপকৃত হলে লেখকের জন্যে দুয়ার দরখাস্ত রইলো।
এবং শেয়ার করে সকল কে পড়ার সুযোগ দিন।
ধন্যবাদ।
3 Comments