পরিবার পরিকল্পনা কি? পরিবার পরিকল্পনা কাকে বলে?
পরিবার পরিকল্পনা কি? এবং জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা বলতে কি বুঝায়?
পরিবার পরিকল্পনা কি? জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা একটি কল্যাণধর্মী কর্মসূচী হিসেবে পরিগণিত হয়। এ কর্মসূচীর প্রবর্তক আমেরিকার মার্গারেট স্যাঙ্গার। তার অক্লাল্ড় প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে।
পরিবার পরিকল্পনা হচ্ছে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের কার্যক্রম। সংকীর্ণ অর্থে জন্মনিয়ন্ত্রণ দ্বারা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্বাস করার প্রচেষ্টাকে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বলা হয়। ব্যাপক অর্থে পরিবারের আয় ও পরিবারের সদস্য সংখ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে পরিকল্পিত উপায়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ছোট পরিবার গড়ে তোলাই পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী পরিবার পরিকল্পনা জীবন-যাপনের এমন একটি চিন্তাধারা ও পদ্ধতি, যা কোন ব্যক্তি বা দম্পতি স্বীয় জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িতৃবোধের প্রেক্ষিতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করে। যাতে পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের উন্নতি সাধিত হয় এবং তারা দেশের সামাজিক উন্নয়নে কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
পরিবার পরিকল্পনা বলতে সে কর্মসূচীকে বুঝায়, যা দ্বারা পরিকল্পিত, ছোট, সুখী, স্বাস্থ্যবান ও সমৃদ্ধশালী পরিবার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সন্তানের জন্মদান পরিকল্পনা অনুযায়ী হওয়াই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর মূলকথা।
পরিবার পরিকল্পনায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরণের নিরাপদ এবং কার্যকরী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু রয়েছে। দম্পতিরা সঠিকভাবে জেনে শুনে প্রচলিত পদ্ধতি গুলোর মধ্য থেকে নিজেদের পছন্দমতো এবং দম্পতির জন্য উপযুক্ত একটি পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন । এ ক্ষেত্রে, যেকোন পদ্ধতি গ্রহণ করার পূর্বে সকল পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনে নিতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি গুলোর ব্যাপারে গ্রহীতাদের যখন একটা সঠিক ধারণা হবে, তখনই দম্পতিদের পক্ষে তাদের জন্য একটি পদ্ধতি বেছে নেয়া সহজ হবে। সরকারি সেবাদানকেন্দ্র সমূহ, সরকারি এবং বেসরকারি পরিবার পরিকল্পনা কর্মীর কাছে, বা পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকে বা ফার্মেসি বা দোকানে যেসকল জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গুলো পাওয়া যায় সেসব জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
অস্থায়ীপদ্ধতি | স্থায়ীপদ্ধতি |
খাবার বড়ি | ভ্যাসেকটমি (এনএসভি) |
কনডম | টিউবেকটমি(লাইগেশন) |
ইনজেকশন | |
আইইউডি | |
ইমপ্ল্যান্ট |
প্রচলিত সকল জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির গুলোর মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে হবে । আমাদের মনে রাখতে হবে যে,
- সকল পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিই সকলের জন্য সমান ভাবে উপযোগী নয়;
- কোনো কোনো পদ্ধতি কোন বিশেষ ব্যক্তির জন্য অধিক গ্রহণযোগ্য;
- দম্পতিকে সন্তান ধারণে সক্ষম বছরে প্রয়োজন অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পরিবার পদ্ধতি গ্রহণ করতে হতে পারে ।
কোন দম্পতির জন্য কোন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি উপযোগী?
পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে, সন্তান সংখ্যা, বয়স, স্বাস্থ্য এবং পছন্দ, সকল বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই সম্পূর্ণ জানতে হবে, যেন, দুজনে একমত হয়ে নিজেদের জন্য উপযোগী জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি গ্রহন করতে পারেন ।
আরো পড়ুন- বিবাহ কি? বা বিবাহ কাকে বলে?
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নির্বাচন
সকল পদ্ধতি সকল দম্পতির জন্য সমান ভাবে উপযোগী নয় । কোন দম্পতির জন্য কোন পরিবার পরিকল্পনা তা নীচের ছকে দেয়া হোল।
দম্পতির ধরণ | পদ্ধতি কখন নেবেন | জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি |
নবদম্পতি | নববিবাহিত দম্পতি , ২-৩ বছর পরে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে। (২০ বছরের পূর্বে সন্তান গ্রহন করলে স্ত্রী এবং সন্তান উভয়েই ঝুকিতে থাকে ) । | বড়ি , কনডম , ইমপ্ল্যান্ট |
যাদের একটি সন্তান আছে | প্রথম সন্তান গ্রহনের পর কমপক্ষে ৩ বছর বিরতির জন্য ( দু ‘ সন্তানের জন্মের বিরতি ৩ বছরের কম হলে শিশুমৃত্যুর ঝুকি অনেক বেড়ে যায় ) । | কনডম, বড়ি ইনজেকশন , আইইউডি , ইমপ্ল্যান্ট |
যাদের দু ‘ টি সন্তান আছে | পরিবারকে দুটি সন্তানেই সীমিত রাখার জন্য ( এ ক্ষেত্রে স্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ) । | কনডম, ইনজেকশন , বড়ি, আইইউডি , ইমপ্ল্যান্ট |
যেসব দম্পতির একাধিক সন্তান আছে , এবং ভবিষ্যতে আর কোনো সন্তান নিতে চান না | যখন দু ‘ টি সন্তান আছে এবং ছোট সন্তান এর বয়স কমপক্ষে দু ‘ বছর; দু ‘ টি সন্তানের বেশি হলে দম্পতি যে কোনো সময় বন্ধ্যাকরণ করতে পারেন । | ভ্যাসেকটমি ( এনএসভি ), টিউবেকটমি , আইইউডি |
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য
পরিবার পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হল পরবারের আর্থ সামাজিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সন্তান লাভ, লালন-পালন, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা এবং তাদের সামগ্রিক কল্যাণে সহায়তা দান।
Read More- পরিবার কাকে বলে? পরিবার কত প্রকার?
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর লক্ষ্যগুলো নিম্নরুপঃ
(১) পরিকল্পনা মাফিক সন্তান গ্রহণে সহায়তা করা;
(২) মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা এবং সবল শিশু লাভে সহায়তা করাঃ
(৩) পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি করা;
(৪) জাতীয় জনসংখ্যা নীতির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তাদান;
(৫) দেশের সম্পদের হিসেবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সীমিত রাখা;
(৬) জনসংখ্যা সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব
বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে স্বীকৃত আদর্শ পদ্ধতি হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা। বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হচ্ছে অধিক জনসংখ্যা। বাংলাদেশের সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশী হওয়ায় এ দেশের সামগিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বিরাজমান অধিক জনসংখ্যা সমস্যার প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত দৃষ্টিকোন হতে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনার গুরুতু তুলে ধরা যায়।
জনসংখ্যাবিদদের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় বিষয়ে দু’টি ভিন্নমত রয়েছে-একটি হচ্ছে
- প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
- পরোক্ষ উপায়ে জন্মহার সীমিত করার পদ্ধতি।
প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের জন্য গর্ভনিরোধ দ্রব্যাদি ব্যবহার এবং গর্ভ নিয়ন্ত্রনের জন্য বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহৃত হইয়ে থাকে। এসব পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এমন এক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, সময় অপচয় করার মত অবকাশ নেই। বর্তমানে বিশ্বে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অর্থ বছর অন্তর বিশ্বের জনসংখ্যা একশত কোটি করে বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যেই বিশ্বের জনসংখ্যা ছয়শত কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। সুতরাং প্রত্যক্ষ উপায় ছাড়া জনাহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। পরোক্ষ উপায়ে জন্মহার সীমিত করার পক্ষপাতী জনসংখ্যাবিদদের মতে জন্মহার দ্রুত কমাতে গেলে গুরুত্ব দেয়া উচিত অর্থনৈতিক বিকাশ এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রতি। জীবনযাত্রার মান উন্নত প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মনিরোধের আশু ফল লাভ করা গেলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। কারণ পরিবার সীমিত রাখার তাগিদ অনুভব না করলে, সাধারণ লোকের পক্ষে জন্মনিয়ন্ত্রণের কার্যকর প্রচেষ্টা গ্রহণ করারই কথা নয়।
বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্যহার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত এজন্য যে, বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে যথেষ্ট সময় নেয়ার সুযোগ নেই। ১৯৯১ সালে হয়া আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হল ২.১৭ এবং এ হারে যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে তবে আগামী বত্রিশ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে । এমতাবস্থায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণই অধিক যুক্তিযুক্ত । প্রত্যক্ষ পদ্ধতি গ্রহণ ব্যতীত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বিশেষ করে এদেশে ।
তবে, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি অবলম্বনের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে-জনগণের মধ্যে ছোট পরিবারগঠনের আকঙ্খা সৃষ্টি। ছোট পরিবার গঠন যাতে সর্বস্তরে জনগণের নিকট কাম্য হয়, সে জন্যজনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষারসম্প্রসারণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ব্যতীত পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের ন্যায় দরিদ্র দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান দারিদ্য সীমার নিচে অবস্থান করছে। এজন্য দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত পরিবারের আকাঙ্খা সৃষ্টি না করতে পারলে, শুধু পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির মাধ্যমে জন্যহার হ্রাস করা সম্ভব নয়। জনগণের জীবনযাত্রার মান
উন্নয়নের করার মাধ্যমে জনগনের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গুলো গ্রহণের আকাঙ্খা সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞমহল মত পোষণ করেন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা মোকাবেলা করার বাস্তবসম্মত জন্য অপরিহার্য হলো পরোক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। পরোক্ষ উপায় গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। ১৯৫৩ সালে পরিবার পরিকল্পনা সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে সর্বপ্রথম পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী সাংগঠনিক মর্যাদা লাভ করলেও ১৯৬৫ সাল থেকে এটি সরকারি পর্যায়ে গৃহীত হয়। ১৯৭৬ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ঘোষণা করা হয় যাতে জাতীয় কর্মসূচী হিসেবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জরিপ, ১৯৯৭-৯৮-এর তথ্যানুযায়ী পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়নে নিগেক্ত সমস্যাগুলো চিহিত করা হয়।
(১) মাঠ পর্যায়ে অপর্যাপ্ত তদারকি ব্যবস্থা;
(২) প্রচলিত পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থাদির অপর্যাপ্ততা;
(৩) সেবা প্রদানে উদ্ুদ্ধকরণ কার্যাবলীর অপর্যাপ্ত সংযোজন;
(৪) মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের উদুদ্ধকরণের অভাব;
(৫) কমিউনিটি পর্যায়ে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ ও প্রয়োগের অভাব প্রভৃতি।
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলোঃ
(১) ধর্মীয় প্রভাব ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিঃ পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত ধর্মীয় অনুশাসনের প্রকৃত ব্যাখ্যার অভাবে এ কর্মসূচীর প্রতি নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যেমন ৪ পর্দা প্রথা, অদৃষ্টবাদিতা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি বিদ্যমান । ধর্মীয় অনুশাসন পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীকে বাধাগ্রস্থ করছে।
(২) নিরক্ষরতাঃ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। নিরক্ষরতার কারণে বৃহৎ জনগোষ্ঠী জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি হিসেবে মূল্যায়ন করে নিজেদের তা গ্রহন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে । এটি যে পরিবার কল্যাণধর্মী কার্যক্রম তা বুঝতে তারা অক্ষম।
(৩) নারীদের সামাজিক মর্যাদাঃ বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা পুরুষ শাসিত এ সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ করার হার শতকরা মাত্র ৫- ১০ ভাগ হওয়ার কারণে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু একথা সত্য যে, পরিকল্পিত পরিবার গঠনে নারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
(৪) দারিদ্য এবং নিম্ন জীবনযাত্রার মানঃ দারিদ্রের প্রভাব ও জীবনযাত্রার মান সাংঘাতিকরকম নিম্নমানের হওয়ায় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী গ্রহণের প্রতি জনগণের মধ্যে অনীহা লক্ষ্য করা যায়।
(৫) পুত্র সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষাঃ পুত্র সন্তান লাভের আকঙ্খা, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের অন্যতম বাধা। Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS)-এর গবেষণা তথ্য অনুযায়ী ৪০টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, জর্ডান, কোরিয়া, নেপাল, পাকিস্তান ও সিরিয়ায় এ প্রবণতা প্রবল এবং শীর্ষে বাংলাদেশ । বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ শতকরা ৯৭ জন পুত্র সন্তান লাভের জন্য অধিক সংখ্যক সন্তান নিতে দ্বিধা করে না। শহুরে জনপদ শতকরা ৮০ ভাগ নারী পুত্র না হওয়া পর্যন্ত সন্তান নিতে ইচ্ছুক। শতকরা দুজন মা-বাবা পরবর্তী সন্তান কন্যা হোক এটি কামনা করে না, তিন পুত্রের জননীদের শতকরা ৯৩ জন একটি কন্যার জন্য অধিক আগ্রহী । ২-৩টি পুত্র এবং একটি কন্যা উপযুক্ত সন্তান সংখ্যা বলে এদেশের জনগোষ্ঠী মনে করে।
(৬) জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো ব্যবহারের জটিলতা এবং পারব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জনগণের ভীতিঃ
বাংলাদেশের প্রচলিত জনানিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো বিদেশী প্রযুক্তি-নির্ভর এবং আমদানিকৃত । জনগোষ্ঠী অজ্ঞতার কারণে এ সব পদ্ধতিগুলো নিয়মিত ও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। তাছাড়া স্থায়ী পদ্ধতিগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও জনগণের মধ্যে ভীতি কাজ করে যা পরিবার পরিকল্পনার অন্যতম অন্তরায়।
(৭) সামাজিক নিরাপত্তার অভাবঃ বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী অত্যন্ত সীমিত এবং শহরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রত্যক্ষ কোন নিরাপত্তা কর্মসূচী না থাকায় বৃদ্ধ বয়সের ভরসা হিসেবে দেখা দেয় সন্তান-সন্ততি |
(৮) মাঠ কর্মীদের সামাজিক মর্যাদাঃ ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা মাঠ কর্মীদেরপরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করতে এবং আগ্রহ সক্ষম হয় না।
(৯) ত্রুটিপূর্ণ উৎসাহ দান পদ্ধতিঃ বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীসহ স্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি গ্রহহীতাদের নগদ অর্থ দেয়ার ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ার ফলে জন্মদানে সক্ষম ও অবিবাহিতরা স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় এ ধরনের কর্মসূচী গুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
(১০) জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অপ্রতুলতাঃ বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রচারণা এবং কার্যক্রমের প্রভাবে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণেরও আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জনানিয়ন্ত্রণ সামগ্রির কম থাকায় ইচ্ছা সত্তেও অনেক পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে সক্ষম হচ্ছে না।
(১১) কর্মসূচী উদ্বদ্ধকরণে দক্ষতার অভাবঃ পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী উদ্দুদ্ধকরণের উপর নির্ভরশীল। জনগণকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে এটি গ্রহণ করার জন্য যে উদ্বুদ্ধকরণ ক্ষমতার প্রয়োজন তা মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে না থাকার ফলে তারা এ কর্মসূচীকে সর্বস্তরের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারছে না।
(১২) সমন্বয় এবং তন্তাবধানের অভাবঃ বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী সরকারি এবং বেসরকারী পর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ কর্মসূচীর সাথে বিভিন্ন সরকারি বিভাগ এবং অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত। এদের কাজের সুষ্ঠ সমন্বয় এবং তত্ত্বাবধানের অভাবে এটি বাংলাদেশের কল্যাণমুখী কর্মসূচী হিসেবে আজও গড়ে উঠতে পারে নি।
এছাড়াও যৌথ পরিবার ব্যবস্থা এবং সন্তান জন্মদান, সন্তান-সন্ততি লালন-পালনের স্বল্প ব্যয়, শিশুশ্রমের প্রতি গুরুতু আরোপ, যৌতুক প্রথার প্রভাবে বাল্যবিবাহের প্রসার, স্বাস্থ্য সেবার অভাব, অধিক শিশু মৃত্যুর হার ইত্যাদি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
সারকথা: পরিবার পরিকল্পনা হচ্ছে পরিকাল্লিত পরিবার গঠনের কার্ধক্রম। পরিবারের আয় এবং পরিবারের সদসা সংখ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে পরিকল্পিত উপায়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধামে ছোট পরিবার গড়ে তোলাই পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্য । বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হল পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সন্তান লাভ, লালন-পালন, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা এবং তাদের সামগ্রিক কল্যাণে সহায়তাদান। কিন্ত বাংলাদেশের এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে ধর্মীয় প্রভাব, নিরক্ষরতা, নারিদের নিম্ন সামাজিক মর্যাদা, দারিদ্র ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান, সামাজিক নিরাপভার অভাব, জন্যনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অপ্রতুলতা, কর্মসূচী উদ্বদ্ধকরণে দক্ষতার অভাব, সমন্বয় এবং তত্তাবধানের অভাব ইত্যাদি । বাংলাদেশের মত একটি অতি জনবহুল দরিদ্র রাষ্ট্রে পরবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা অতিব জরুরি।
2 Comments