রোজা ভঙ্গের কারণ কি কি? রোজা মাকরুহ হবার কারণ গুলো
রোজা ভঙ্গের কারণ। রোজা মাকরুহ হবার কারণ।
হ্যা রমজান এসে গেছে। রমজানের পবিত্রতা রক্ষা আমাদের ঈমানি দ্বায়িত্ব।আর রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করতে আমাদের অবশ্যই রোজা ভঙ্গের কারণ কি কি তা জানা উচিত। বিশেষ করে যুবক ভাইয়েরা যদি রমজান মাসটিকে মনে প্রাণে ধারণ করে অশ্লীলতা থেকে নিজেদের হেফাজত ও অন্যকে পরামর্শ দেয় তাহলে অনেকাংশে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা সম্ভব। নিজেরদের এবং অন্যদের হেফাজত করতে আমরা আর আলোচনা করব রোজা ভঙ্গের কারণ, রোজা মাকরুহ হবার কারণ, বা কোন কোন ক্ষেত্রে রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ রয়েছে।
চলুন শুরু করি।
নবী করিম রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন যে, ‘তোমরা কেউ যদি সাওম পালন কর তবে সে যেন পাপাচারে লিপ্ত না হয় এবং আচরণ যেন মূর্খের মতো না হয়।’
______ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৬৩)
বিশেষ করে চায়ের দোকান কিংবা রেস্টুরেন্টে আড্ডা, টিভি সিনেমায় বা মোবাইল ফোনে অশ্লিলতা, নগ্নতা দেখা বন্ধ করা। নিজে ধুমপান পরিহার করা ও অন্যকে ধুমপান করা থেকে বিরত রাখা, যতো কষ্টই হোক মিথ্যা না বলা, অসৎ কাজ বন্ধ করে সৎ কাজ করা, কু-অভ্যাস পরিত্যাগ করা। এছাড়াও সকলের সাথে নিম্নস্বরে কথা বলা ও সালাম বিনিময় করা।
মা-বোনেরা রাস্তায় পর্দার সহিত বের হওয়া। সর্বদা মনে রাখা আমার শরীরের দিকে তাকালে যেন কারো রোযা ভঙ্গ না হয়। পারফিউম ব্যবহার না করা। নিজের রোযা যেন নষ্ট না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। অন্যের দোষ ত্রুটি খোঁজা ও গীবত করা থেকে বিরত থাকা।
এক হাদিসে এরশাদ হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তি সকল গুনাহের কাজ গুলো ত্যাগ করে না, মিথ্যা-প্রতারণা বন্ধ করে না, মহান আল্লাহ তাআলার নিকট তার পানাহার থেকে বিরত থাকা বা রোজা রাখার কোনো মূল্যই নেই।’
____________(আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩৬২)
ব্যবসায়ী ভাইয়েরা প্রয়োজনীয় দ্রব্যপণ্যের দাম ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখুন। রমজান মাসে এমন কিছু করা যাবে না যা শরীয়া পরিপন্থী। মাপে কম বেশি করবেন না। ক্রেতা ঠকে এমন কোনো কাজ করবেন না। সর্বদা মনে রাখবেন নিশ্চয়ই আল্লাহ সব দেখেন।
রোজা অবস্থায় হাত, পা, কানসহ পুরো শরীরও যাতে রোজা রাখে এমন কাজ করতে হবে। প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে গুনাহ থেকে হেফাজত রাখতে হবে।
মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে ঈমানি চেতনা বৃদ্ধি করে দিন। আমিন।
রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ বা রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি?
প্রথমত এবং সাধারণত রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে মূলত তিনটি কাজ রয়েছে। সেগুলো হলো- স্ত্রী-সম্পর্ক, খাওয়া, পান করা। তবে এগুলো ছাড়াও কিছু কারণে রোজা ভেঙে যায়। যেগুলো জেনে রাখা প্রত্যেক রোজাদারের জন্য জরুরি। সংক্ষেপে সেসব কারণ হলো—
১। ভুলে খাওয়া বা পান করার পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে আবার ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া বা পান করা। (ফাতওয়া শামি, খণ্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৭৫)
২। বিড়ি-সিগারেট বা হুঁকা সেবন করা। (জাওয়াহিরুল ফিকাহ, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ৩৭৮)
৩। কাঁচা চাল, আটার খামির বা একত্রে অনেক লবণ খাওয়া। (ফাতওয়া আল-হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ১৯৯)
৪। এমন কোনো বস্তু খাওয়া, যা সাধরণত খাওয়া হয় না। যেমন- কাঠ, লোহা, কাগজ, পাথর, মাটি, কয়লা ইত্যাদি। (ফাতওয়া আল-হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ২০২; জাওয়াহিরুল ফিকাহ, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ৩৭৮)
৫। পাথর, কাদামাটি, কঙ্কর, তুলা-সুতা, তৃণলতা, খড়কুটো ও কাগজ গিলে ফেলা। (ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ২০৩)
৬। নিজের থুতু হাতে নিয়ে গিলে ফেললে। (ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ২০২)
৭। ভুলে স্ত্রী সম্ভোগের পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে— আবার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস সম্পর্ক করা। (ফাতওয়া শামি, খণ্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৭৫)
৮। কানে বা নাকের ছিদ্র দিয়ে তরল ওষুধ দেওয়া। (ইমদাদুল ফাতাওয়া, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ১২৭)
৯। দাঁত দিয়ে রক্ত বের হলে যদি তা থুতুর চেয়ে পরিমাণে বেশি হয় এবং কণ্ঠনালিতে চলে যায়। (ফাতাওয়া শামি, খণ্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৬৭)
১০। মুখে পান দিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া এবং এ অবস্থায় সুবহে সাদিক করা। (ইমদাদুল ফাতাওয়া, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ১৭২)
১১। হস্তমৈথুন করা। (ফাতাওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ, খণ্ড : ০৬, পৃষ্ঠা : ৪১৭)
১২। রোজা স্মরণ থাকা অবস্থায় কুলি কিংবা নাকে পানি দেওয়ার সময় কণ্ঠনালিতে পানি চলে যাওয়া। (আহসানুল ফাতাওয়া, খণ্ড : ০৪, পৃষ্ঠা : ৪২৯)
১৩। কাউকে জোর-জবদস্তি করে পানাহার করানো। (ফাতাওয়া হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ২০২)
১৪। রাত মনে করে সুবহে সাদিকের পর সাহরি খাওয়া। (জাওয়াহিরুল ফিকাহ, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ৩৭৮)
১৫। ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা বা বমি আসার পর তা গিলে ফেলা। (ফাতহুল কাদির, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ৩৩৭)
১৬। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে মনে করে ভুলে দিনে ইফতার করা। (বুখারি, হাদিস : ১৯৫৯)
১৭। যদি কেউ রাত ধারণা করে স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয়ে যায়, অতঃপর সুবহে সাদিকের কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ সহবাস থেকে বিরত হয়ে যায়। (ফাতওয়া শামি, খণ্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৭৪)
১৮। বৃষ্টি বা বরফের টুকরো খাদ্যানালির ভেতরে চলে গেলে রোজা ভেঙে যায়। (ফাতাওয়া হিন্দিয়্যা, খণ্ড : ০১, পৃষ্ঠা : ২০৩)
আর যদি রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে স্বামী-স্ত্রী সহবাস অথবা পানাহার করে তবে কাজা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে। কাফফারার মাসআলা অভিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের থেকে জেনে নেবে।
আরো পড়ুন- ইফতারের দোয়া ও ইফতারের সময় করণীয়
আরো পড়ুন- সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি ২০২২ (ডাউনলোড)
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হবে
* অনাবশ্যক কোনো জিনিস চিবানো বা চাখা
* কোনো দ্রব্য মুখে দিয়ে রাখা
*গড়গড় করা বা নাকের ভেতর পানি টেনে নেয়া কিন্তু পানি যদি নাক দিয়ে গলায় পৌঁছে যায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে
* ইচ্ছাকৃত ভাবে মুখে থুথু জমা করে তা গলাধঃকরণ করা
* ঝগড়া-ফাসাদ, গীবত, গালা-গালি করা। কেউ যদি গায়ে পড়ে ঝগড়া-ফাসাদ সৃষ্টি করতে আসে তবে বলবে, আমি রোজাদার, তাই তোমাকে প্রত্যুত্থর দিতে অক্ষম।
* সাড়া দিন নাপাক অবস্থায় থাকা। এটি অত্যন্ত গুনাহের কাজ
* অস্থিরতা ও কাতরতা প্রকাশ করা
* কয়লা চিবিয়ে কিংবা পেস্ট, পাউডার, ও মাজন ইত্যাদি দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা
কাযা আদায় শর্তে যেসকল কারণে রোজা না রাখলেও ক্ষতি নেই
* অসুখের ফলে রোযা রাখার শক্তি হারিয়ে গেলে অথবা অসুখ আরো বৃদ্ধির আশংকা হলে। তবে এরূপ কারণে রোজা না রাখলে পরে তা অবশ্যই কাযা করতে হবে।
* রোজা রাখার ফলে গর্ভবতী স্ত্রী লোকের সন্তান কিংবা নিজের প্রাণ নাশ হবার আশঙ্কা হলে অবশ্যই রোজা ভঙ্গ করা বৈধ, তবে পরবর্তীতে কাযা করে দিতে হবে।
* যেসকল স্ত্রী লোকেরা নিজের কিংবা অপরের বাচ্চাদের দুধ পান করান, তাদের রোজা রাখার ফলে যদি ভালভাবে দুধ না আসে সেক্ষেত্রে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে কিন্তু পরে তা অবশ্যই কাযা আদায় করে নিতে হবে।
* শরিয়তসম্মত মুসাফির অবস্থায় রোযা না রাখার অনুমতি আছে। তবে রাখাই উত্তম।
* কেউ যদি হত্যার হুমকি দেয় তবে রোযা ভঙ্গের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু পরে তা কাযা করতে হবে।
* কোনো রোগীর পিপাসা বা ক্ষুধা যদি এমন পর্যায়ে চলে যায় যা মৃত্যুর কারণ হবে তবে রোযা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। এবং পরে তা কাযা করতে হবে।
* মহিলাদের ক্ষেত্রে হায়েজ-নেফাসগ্রস্ত সময়ে (বিশেষ সময়ে) রোজা রাখা জায়েজ নয়। এবং পরবর্তীতে কাযা আদায় করতে হবে।
যেসব বিষয় রোজা ভঙ্গের কারণ নয়:
০১. অনিচ্ছাকৃত ভাবে যদি গলার ভেতর মশা-মাছি, ধুলা-বালি, ধোঁয়া প্রবেশ করে।
০২. অনিচ্ছাকৃত কানে পানি প্রবেশ করা।
০৩. অনিচ্ছাকৃত ভাবে যদি বমি আসে তবে। অথবা যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে অল্প পরিমাণ বমি করলে (মুখ না ভরে)।
০৪. বমি আসবে অনুভব করার পর যদি বমি নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যাওয়া।
০৫. চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করা।
০৬. ইনজেকশন নেয়া।
০৭. ভুলক্রমে পানাহার করা।
০৮. কিছুর ঘ্রাণ নেয়া বা সুগন্ধি ব্যবহার করা।
০৯. নিজ মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি না ফেলে যদি গলাধঃকরণ করা হয়।
১০. শরীর ও মাথায় তেল ব্যবহার করা।
১১. ঠাণ্ডার জন্য গোসল করা।
১২. মিসওয়াক করা। যদিও মিসওয়াক করার দরুন দাঁত থেকে রক্ত বের হয়। তবে শর্ত হলো গলার ভেতর না পৌঁছানো।
১৩. ঘুমের মাঝে স্বপ্নদোষ হলে।
১৪. স্ত্রীলোকের দিকে তাকানোর কারণে কোনো কসরত ছাড়া বীর্যপাত হলে।
১৫. স্ত্রীকে চুম্বন করলে এবং যদি বীর্যপাত না হয় ( যদিও রোজা ভাঙ্গবে না তবে এটা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী)।
১৬. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা গোশত খেয়ে ফেললে (যদি পরিমাণে কম হয়), পরিমাণ বেশি হলে রোজা ভেঙে যাবে।
কোন প্রশ্ন থাকলে বা মাসলা মাসায়েল সম্পর্কে জানতে চাইলে কমেন্টে জানাতে পারেন। আপনাদের নির্ভুল উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
আমাদের অন্যান্য ইসলামিক পোস্ট গুলো পড়তে পারবেন এখান থেকে- ইসলাম ধর্ম
3 Comments