শব্দ গঠন বলতে কি বোঝ? নতুন শব্দ গঠনের উপায় কি কি?
উপসর্গ কাকে বলে? প্রত্যয় কাকে বলে? সমাস কাকে বলে?
শব্দ গঠন বলতে কি বোঝ?
শব্দ গঠন বলতে সাধারনত শব্দ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এক কিংবা একাধিক ধ্বনি মাধ্যমে তৈরি শব্দের মূল অংশটিকে শব্দমূল বলে। শব্দমূলের এক নাম প্রকৃতি। প্রকৃতি ২ ধরনের: নামপ্রকৃতি এবং ক্রিয়াপ্রকৃতি।
ক্রিয়াপ্রকৃতির অন্য নাম ধাতু । নামপ্রকৃতি ও ধাতুর সঙ্গে কিছু শব্দাংশ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়। নামপ্রকৃতির উদাহরণ: মা, গাছ, শির, লতা ইত্যাদি। ধাতুর উদাহরণ: কর্, যা, চল্, ধূ ইত্যাদি।
নামপ্রকৃতি এবং ধাতুর সঙ্গে যেসব শব্দাংশ গুলোযুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়, সেগুলোকে বলে উপসর্গ ও প্রত্যয়।
উপসর্গ কাকে বলে?
যেসব শব্দাংশ শব্দমূলের পূর্বে বসে নতুন শব্দ গঠন করে, সেগুলোকে উপসর্গ বলে।
যেমনঃ ‘পরিচালক’ শব্দের ‘পরি’ অংশ একটি উপসর্গ ।
প্রত্যয় কাকে বলে?
যেসব শব্দাংশ শব্দমূলের পরে বসে নতুন শব্দ গঠন করে, সেগুলোকে প্রত্যয় বলে।
যেমনঃ ‘সাংবাদিক’ শব্দের ইক’ অংশ একটি প্রত্যয়।
আমরা জানি যে, উপসর্গ ও প্রত্যয় দিয়ে তৈরি করা শব্দকে সাধিত শব্দ বলা হয়।
উপসর্গ ও প্রত্যয় ছাড়া শব্দ গঠনের আরো কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রক্রিয়া হলো সমাস, যার মাধ্যমে একাধিক শব্দ এক শব্দে পরিণত হয়।
যেমন ‘হাট’ ও ‘বাজার’ শব্দ দুটি সমাসবদ্ধ হয়ে হয় “হাটবাজার’ ৷
এছাড়া কোনো শব্দের দ্বৈত ব্যবহারে নতুন শব্দ গঠিত হলে তাকে বলে শন্দদ্বিত্ব, যেমন “ঠক’ ও “ঠক’ মিলে গঠিত হয় ঠিকঠক”‘, একইভাবে “অঙ্ক ও অনুরূপ ধ্বনি টঙ্ক’ মিলে হয় “অস্কটন্ক” ।
উপসর্গ দিয়ে শব্দ গঠন
যেসব অর্থহীন শব্দাংশ অন্য শব্দের শুরুতে বসে নতুন শব্দ গঠন করে, সেগুলোকে উপসর্গ বলে। অজানা (অ+জানা), অভিযোগ (অভি+যোগ), বেতার (বে+তার) প্রভৃতি শব্দের “অ’, “অভি’, ‘বে’ হলো উপসর্গ ।
অনেক সময়ে শব্দের শুরুতে একসঙ্গে একাধিক উপসর্গ বসতে পারে । যেমন, ‘সম্প্রদান’ শব্দে “দান’-এর আগে ‘সম্ণ এবং ‘প্র’ _ এই দুটি উপসর্গ যুক্ত হয়েছে। একইভাবে “বিনির্মাণ’ শব্দে ‘মান’-এর আগে বসেছে “বি’ এবং নির্ঃ উপসর্গ
উপসর্গের অর্থ নেই, কিন্তু অর্থের দ্যোতনা তৈরি করার ক্ষমতা আছে।
উপসর্গের নিজের অর্থ নেই; কিন্তু নতুন নতুন অর্থবোধক শব্দ তৈরিতে উপসর্গ গুরুতৃপূর্ণ ভূমিকা রাখে । এজন্য বলা হয় – উপসর্গের অর্থ নেই, কিন্তু অর্থের দ্যোতনা তৈরি করার ক্ষমতা আছে।
বাংলা ভাষায় অর্ধশতাধিক উপসর্গ রয়েছে।
উপসর্গের কাজ
নতুন শব্দ তৈরি করা উপসর্গের কাজ।
যেমন – সম্+বাদ _ সংবাদ, বি+বাদ – বিবাদ। “বাদ শব্দের সঙ্গে সম” এবং “বি’ উপসর্গ যোগ করে নতুন শব্দ ‘সংবাদ’ ও “বিবাদ’ তৈরি হলো।
উপসর্গের আর একটি কাজ শব্দের অর্থ পরিবর্তন করা। যেমন – সু+নজর _ সুনজর (অর্থের সংকোচন); সম্+পূর্ণ _ সম্পূর্ণ অর্থের সম্প্রসারণ); গর+হাজির – গরহাজির (বিপরীত অর্থ) ইত্যাদি।
নিচে কয়েকটি সুপরিচিত উপসর্গের অর্থদ্যোতনা, সাধিত শব্দ ও বিশ্লেষণ দেখানো হলো।
প্রত্যয় দিয়ে শব্দ গঠন
শব্দ এবং ধাতুর পরে অর্থ নেই এমন যেসব শব্দাংশ যুক্ত হয়ে নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়, সেগুলোকে প্রত্যয় বলে। যেমনঃ পঠ্+অক-পাঠক; দিন+ইক _ দৈনিক; দুল্+অনা _ দোলনা; কৃ+তব্য _ কর্তব্য।
শব্দের পরে সাধারনত যেসব প্রত্যয়গুলো যুক্ত হয়, সেগুলোকেই তদ্ধিত প্রত্যয় বলে।
আমরা জানি যে তদ্ধিত প্রত্যয় সাধিত শব্দগুলোকেই তদ্ধিতান্ত শব্দ বলা হয়। উপরের উদাহরণে, ‘অক’ ও “ইক’ তদ্ধিত প্রত্যয় এবং ‘শিক্ষক’ ও “দৈনিক’ হলো তদ্ধিতান্ত শব্দ।
অন্যদিকে ধাতুর পরে যেসব প্রত্যয় যুক্ত হয়, সেগুলোকে কৃতপ্রত্যয় বলে।
কৃষ্পরত্যয় দিয়ে সাধিত শব্দকে বলে কৃদন্ত শব্দ। উপরের উদাহরণে, ‘অনা” ও “তব্য’ হলো কৃত্পত্যয় এবং ‘দোলনা’ ও ‘কর্তব্য’ হলো কৃদন্ত শব্দ।
প্রত্যয়ের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। তবে প্রত্যয় যুক্ত হওয়ার পরে অনেক সময়ে শব্দের অর্থ ও শ্রেণিপরিচয় বদলে যায়।
নিচে প্রত্যয় দিয়ে গঠিত শব্দের উদাহরণ দেওয়া হলো:
সমাস দিয়ে শব্দ গঠন
আমরা জানি যে, সমাস এর মাধ্যমে নতুন শব্দ গঠিত হয়। বাক্যের অন্তর্গত পরস্পর সম্পর্কিত একাধিক পদ গুলোর এক শব্দে পরিণত হওয়ার নাম সমাস।
নিচের বাক্য দুটির দিকে তাকানো যাক:
- ১ম বাক্য: পরীক্ষাগুলোর নিয়ন্ত্রক পরীক্ষার সময় সংক্রান্ত সূচি স্কুল ও কলেজে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।
- ২য় বাক্য: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষার সময়সূচি স্কুল-কলেজে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ।
১ম বাক্যের ‘পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক”, ‘সময় সংক্রান্ত সূচি’ এবং “ফুল ও কলেজ” পদগুলো ২য় বাক্যে যথাক্রমে “পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’, ‘সময়সুচি’ এবং ‘ফুল-কলেজ’ হিসেবে সংক্ষিপ্ত হয়েছে। এই সংক্ষেপ প্রক্রিয়ার নাম সমাস।
সমাসবদ্ধ শব্দকে বলে সমন্তপদ। যেমন “পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক”, “সময়সূচি’ এবং “স্কুল-কলেজ’ ।
সমস্যমান পদের প্রথম অংশের নাম পূর্বপদ এবং শেষ অংশের নাম পরপদ। এখানে “পরীক্ষা’, সময়” ও “ছুল’ হলো পূর্বপদ এবং“নিযনত্রক’, ‘সূচি’ ও ‘কলেজ’ হলো পরপদ।
যেসব শব্দ দিয়ে সমন্তপদকে ব্যাখ্যা করা হয়, তাকে ব্যাসবাক্য বলে।
এখানে “পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’ পদের ব্যাসবাক্য হলো ‘পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক”, ‘সময়সূচি’ পদের ব্যাসবাক্য হলো “সময় সংক্রান্ত সূচি’ এবং “স্কুল-কলেজ’ পদের ব্যাসবাক্য হলো “কুল ও কলেজ’।
এছাড়া যেসব পদ নিয়ে সমাস হয়, সেগুলোকে সমস্যমান পদ বলে।
১ম বাক্যের ‘পরীক্ষাসমূহের নিয়নত্রক’ পদগুলোর “পরীক্ষাসমূহের’ এবং ‘নিয়ন্ত্রক’ হলো সমস্যমান পদ। সমস্তপদ সাধারণত এক শব্দ হিসেবে লেখা হয়, যেমন ‘সময়সূচি’।
উচ্চারণ কিংবা অর্থের বিভ্রান্তি হয়ার আশঙ্কায় কিছু ক্ষেত্রে পূর্বপদ এবং পরপদের মাঝখানে হাইফেন (-) বসে, যেমন “স্কুল-কলেজ’। কিছু ক্ষেত্রে পূর্বপদ এবং পরপদ গুলোকে আলাদা লেখা হয়, যেমন “পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক” ।
সন্ধির সাহায্যেঃ পরস্পর সন্নিহিত দুটি বর্ণের মিলনকেই সন্ধি বলে। সন্ধির সাহায্যে নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়। যেমন – রবি + ইন্দ্র = রবীন্দ্র, বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয়, নে + অন =, নয়ন ইত্যাদি।
দ্বিরুক্তির মাধ্যমেঃ দ্বিরুক্ত অর্থ বলতে দুবার উক্ত হয়েছে এমন শব্দগুলো কে বুঝায়। যেমন – আমার জ্বর জ্বর লাগছে। দিন দিন, হন হন, মোটা মোটা ইত্যাদি।
বাগধারার মাধ্যমেঃ বাগধারা শব্দের আভিধানিক অর্থ বলতে বুঝায় কথার বচন ভঙ্গি বা ভাব বা কথার ঢং। বাক্য বা বাক্যের একটি অংশের বিশেষ প্রকাশ ভঙ্গিকে বলা হয় বাগধারা। যেমন – মুখে আনা ( অর্থাৎ উচ্চারণ করা), মুখ করা (অর্থাৎঝগড়া করা) ইত্যাদি।
পদ পরিবর্তনের সাহায্যেঃ একটি শব্দকে বিশেষ্য রূপ থেকে বিশেষণ রূপে পরিবর্তন এবং বিশেষণ থেকে বিশেষ্য রূপে পরিবর্তন করাকে পদ পরিবর্তন বা পদান্তর বলে। পদ পরিবর্তনের মাধ্যমেও আমরা নতুন শব্দ তৈরি করতে পারি। যেমন – লোক > লৌকিক, কবি > কাব্য ইত্যাদি।
বিভক্তিযোগেঃ শব্দের পরে যদি বিভক্তি যুক্ত হয় তাহলে তা পদে পরিণত হয়। তাছাড়া যেকোন বাক্যের বচন পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও বিভক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নতুন অর্থ প্রকাশ পায়। যেমন – বালক + এরা = বালকেরা, বৃক্ষ + এ = বৃক্ষে ইত্যাদি।
শব্দ গঠন বলতে কি বুঝ? এই পর্বে আশা করি আপনার কিভাবে শব্দ গঠন করতে হয় তা ভালভাবেই বুঝেছেন। এছাড়া, শব্দ গঠন নিয়ে আমাদের আরো অনেক পোস্ট রয়েছে। নিচে লিংক এ ক্লিক করলেই পাবেন।
শব্দ গঠন নিয়ে অন্যান্য আর্টিকেল
আমাদের পিডিএফ বই কালেকশান গুলো পেতে |
4 Comments