সাম্য কী বা কাকে বলে? সাম্য কত প্রকার ও কী কী? সমাজ জীবনে সাম্যের গুরুত্ব

সাম্যের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি

সাম্যের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি

সাম্য কী?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘সাম্য’ (Equality) সম্পর্কিত আলোচনা সর্বকালের আলোচিত বিষয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পর্যন্ত সবাই সাম্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সাম্যের উপস্থিতি গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করে। স্বাধীনতা সাম্য ছাড়া অর্থহীন। সাম্য ও স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্রের কথা চিন্তা করা যায় না। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতার ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করতে হলে সাম্যনীতির সফল প্রয়োগ অপরিহার্য।

 

সাম্য কাকে বলে? (Definition of Equality)

সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বুঝায়- সকল মানুষই পরস্পর সমান ও অভিন্ন। মানুষের মধ্যে কোন প্রার্থক্য বা ভেদাভেদ নাই।

১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণায় (Amarican Declaration of Independence) বলা হয়, ‘সকল মানুষই সমান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে।’

তাই বলা যায়, সাম্য বলতে সাধারণ অর্থে মানুষে মানুষে সমতা বুঝায়।

তবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘সাম্য’ কথাটির বিশেষ অর্থ রয়েছে। ‘সকলেই সমান’- এ অর্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্যের ধারণাটি গৃহীত হয়, সকল মানুষের কর্মক্ষমতা, বিদ্যাবুদ্ধি, মেধা, নৈতিকতার ধারণা এবং বিশ্বাস কখনও এক হতে পারে না।

বাস্তব জীবনে দেখা যায়, মানুষের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে অসমতা বিরাজমান। এছাড়া দৈহিক গঠন ও আকৃতির অসমতা তো রয়েছেই।

তাই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্যের প্রকৃত অর্থ হলো সকলের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের উপযুক্ত সুযোগ সুবিধার সমতা।
অধ্যাপক লাস্কি (Laski) এর মতে, “সাম্য অর্থ আচরণের সমতা নয়, সাম্য বলতে সকলের জন্য উপযুক্ত সুযোগ সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত রাখাকেই বুঝায়।”

অধ্যাপক বার্কার (Barker)-এর মতে, “সাম্যের অর্থ হলো প্রত্যেক নৈতিক ব্যক্তি তার সর্বাত্মক দক্ষতা এবং সে দক্ষতা প্রকাশের ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য সকলের মত সমান সুযোগ সুবিধার অধিকারী।”

তাই বলা যায়, সাম্য বলতে মানুষের জীবনের এক ধরনের পরিবেশকে বুঝায় যেখানে জাতি-গোত্র-বর্ণ-ধর্ম ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় এবং সবাইকে সমানভাবে ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও আত্মবিকাশের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়।

আরও পড়ুন:

আইন কাকে বলে? আইনের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও উৎস কী?

স্বাধীনতা কাকে বলে? স্বাধীনতা কত প্রকার ও কী কী?

সাম্যের প্রকারভেদ (Types of Equality)

সাম্য কত প্রকার ও কী কী?

সাম্যের ধারণা ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর কোন শ্রেণীবিভাগ হয় না। তবুও বিভিন্ন কারণে সাম্যকে বিভিন্ন উপায়ে শ্রেণীবিভাগ করা হয়ে থাকে। সাম্যের শ্রেণীবিভাগ বা প্রকারভেদ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতভেদ রয়েছে।

বার্কার (Barker) এর মতে, সাম্য দুই ধরনের। যথা- আইনগত সাম্য ও সামাজিক সাম্য। আবার অধ্যাপক লাস্কি (Laski) এর মতে, সাম্য দুই ধরনের। যথা-রাজনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য।

তবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সাম্যকে সাত ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-

  • প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক সাম্য (Natural or innate Equality)।
  • ব্যক্তিগত বা নাগরিক সাম্য (Civil Equality)।
  • সামাজিক সাম্য (Social Equality) ।
  • রাজনৈতিক সাম্য (Political Equality)।
  • অর্থনৈতিক সাম্য (Economic Equality)।
  • আইনগত সাম্য (Legal Equality)।
  • শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সাম্য (Educational and Cultural Equality)।

আরও পড়ুন:

পরিবার কাকে বলে? পরিবারের শ্রেণিবিভাগ 

যৌথ পরিবারের সুবিধা ও অসুবিধা

সুশাসন বলতে কি বুঝায়?

নিম্নে এগুলোর বিস্তারিত অোলোচনা করা হলো- 

প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক সাম্য: প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক সাম্য বলতে বুঝানো হয়- ‘জন্মগতভাবে সকল মানুষ সমান, মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই।’ স্বাভাবিক সাম্য ও সমান অধিকারের আদর্শ সর্বপ্রথম প্রচার করেন প্রাচীন গ্রিসের স্টোয়িক দার্শনিকগণ। ক্রীতদাস প্রথার বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা মানুষের স্বাভাবিক সাম্যের কথা বলেছেন। এছাড়া, রোমান দার্শনিকগণও স্বাভাবিক সাম্যের কথা প্রচার করেছেন।

পরবর্তী সময়ে জন লক, ভলটেয়ার, রুশো প্রমুখ ব্যক্তি সাম্যের তত্ত্বকে বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করেছেন। তাছাড়া আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা ও ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণায় প্রাকৃতিক সাম্যের আদর্শ ফুটে উঠেছে।  তবে বর্তমানে এরূপ সাম্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় না।

 

ব্যক্তিগত বা নাগরিক সাম্য: সমাজের সকল সদস্য ‍যখন সমানভাবে সকল সুবিধা ভোগ করে তখনই ব্যক্তিগত বা নাগরিক সাম্য বিদ্যমান বলে ধরা হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এ সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোন ভেদাভেদ করা উচিত নয় ।

সামাজিক সাম্য:  জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যখন সমাজের সকল মানুষকে সমান সামাজিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় তখন তাকে সামাজিক সাম্য বলে।  অর্থাৎ, সামাজিক সাম্য বলতে এমন এক ধরনের অবস্থা বুঝায় যেখানে প্রত্যেকে যোগ্যতা অনুযায়ী সমানভাবে সামাজিক অধিকারসমূহ উপভোগ করতে পারে। সামাজিক সাম্যে সবাই একই আইনের অনুশাসনে শাসিত হয়। সমাজে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি না হলে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

রাজনৈতিক সাম্য: প্রত্যেক নাগরিকের রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের সমান অধিকারকে রাজনৈতিক সাম্য বলে।  জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যদি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভোটাধিকার লাভ করে, নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পায়. স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের পায় তা হলে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে প্রত্যেক নাগরিক তার ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটাতে স্বাধীনভাবে কার্য করতে পারে। গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক সাম্য।

অর্থনৈতিক সাম্য: জীবনধারণের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা অনুয়ায়ী যে কোন পেশায় সমান সুয়োগ লাভের অধিকারকে অর্থনৈতিক সাম্য বলে।  সমাজের নিঃসম্বল ও নিরাশ্রয়দের নিকট রাজনৈতিক সাম্য ও স্বাধীনতার কোন মূল্য নেই।

তবে অর্থনৈতিক সাম্যের অর্থ এই নয় যে, দেশের সম্পদকে সমানভাবে সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। অথবা যোগ্যতা না থাকলেও সকলকে দায়িত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের অধিকার দিতে হবে।

তাই বলা যায়,  অর্থ উপার্জন ও বণ্টন বিষয়ে বৈষম্য দূর করে যোগ্যতার ভিত্তিতে সকলকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করাকে অর্থনৈতিক সাম্য বলে।

আইনগত সাম্য: আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান অধিকার ভোগ করাকে আইনগত সাম্য বলে। আইনগত সাম্যের প্রকৃত অর্থ হলো আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। তবে অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক সমাজে আইনগত সাম্য উপলব্ধি করা কষ্টসাধ্য। কারণ এতে ধনী ও গরীব সমানভাবে আইনের সুফল লাভ করে না। কাজেই আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সামাজিক বৈষম্যের অপসারণ।

 

শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সাম্য: সাংস্কৃতিক সাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শিক্ষার ক্ষেত্রে সাম্য। বার্কার (Barker) -এর মতে, “রাষ্ট্র শিক্ষার ক্ষেত্রে ন্যূনতম অধিকার প্রদান করেছে। বর্তমান রাষ্ট্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উন্নত গুণাবলি প্রমাণের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রবেশাধিকার সম্প্রসারিত করা হয়েছে।” কিন্তু তথাপিও শিক্ষার ক্ষেত্রে অসাম্যের অবসান ঘটে নি। সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু অথবা ধনী-দরিদ্রের শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে প্রবল অসাম্য বিরাজমান।

 

সমাজজীবনে সাম্যের গুরুত্ব (Importance of Equality in Social Life)

 

সভ্য সমাজ সাম্যের মাধ্যমেই সূচিত হয়। সাম্যের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সমাজজীবনে সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে- গণতন্ত্রের আরেকটি অর্থ হলো সামাজিক গণতন্ত্র। সামাজিক গণতন্ত্র বলতে এক ধরনের সমাজ ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধর্ম, জাত নির্বিশেষে কোন ভোদাভেদ থাকেনা।  তাই বলা যায়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাম্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় – ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় সাম্যের গুরুত্ব রয়েছে। সামা ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটি শব্দ। সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। সাম্য ব্যক্তিস্বাধীনতার পথকে উন্মুক্ত করে দেয়। কারণ মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ থাকলে সবল ব্যক্তিরা সবসময় দুর্বলদের উপর হস্তক্ষেপ করে। তাই ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় সাম্যের গুরুত্ব রয়েছে।

 

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায়- অর্থনৈতিক সাম্য বিঘ্নিত হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়। সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক ব্যক্তিকে কর্মের অধিকার এবং জীবনযাত্রার সর্বনিম্ন মানের নিশ্চয়তা দিয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। সুতরাং ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় সায্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকাৰ্য।

 

সমাজে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে- সমাজে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্যও সাম্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সমাজে অসাম্য বিরাজ করলে শান্তি নষ্ট হয়। কারণ দরিদ্ররা মানুষেরা জীবিকা নির্বাহের তাগিদে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই প্রভৃতি সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটায়। তাই সমাজে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্যের প্রয়োজন।

 

আয় ও সম্পদের সমবণ্টনে- সাম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় আয় ও সম্পদের মধ্যে বৈষম্য বিরাজ করে। এর ফলে ধনী ও গরীব দুইটি শ্রেণীতে সমাজ ভাগ হয়ে যায়।  একদিকে, ধনীরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে অন্যদিকে, দরিদ্ররা দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করে। কিন্তু সাম্য ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সকল সম্পদের ভোগ জনগণ সমানভাবে করতে পারে।

সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে- সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সাম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।  কেননা, সমাজে অসাম্য সৃষ্টি হলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ হ্রাস পায়। এর ফলে সমাজে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালবাসা সৃষ্টিতে সাম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন কররে।

 

######

এই পোস্ট থেকে আমরা সাম্য কী বা কাকে বলে? সাম্য কত প্রকার ও কী কী? সমাজ জীবনে সাম্যের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারলাম। পোস্টটি কেমন লাগলো আমাদের কমেন্ট করে জানান। ধন্যবাদ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button